একটি দাগহীন, মসৃন ত্বক আমাদের সবার পছন্দ। কিন্তু নানা সময় যত্নের অভাবে বা বিভিন্ন কারণে আমাদের ত্বকে বিভিন্ন ধরণের সমস্যা দেখা দেয়, যা ত্বকের সৌন্দর্য নষ্ট করে তার মধ্যে ব্রণ অন্যতম।
অনেক সময় ব্রণ এর প্রভাব শুধু আমাদের চেহারায় নয়, আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, ব্রণে আক্রান্ত মানুষেরা নিজেদের মধ্যে কম আত্মবিশ্বাস অনুভব করে এবং এটি এক সময় তাদের ডিপ্রেশনের দিকে নিয়ে যায়।
আজকে আমরা ব্রণ কেন হয় সে সম্পর্কে জানবো। এছাড়া ব্রণ কি, ব্রণ কিভাবে তৈরী হয়, ত্বকে বিভিন্ন ধরণের ব্রণ, ব্রণের প্রতিরোধ এবং প্রতিকার ব্যবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
ব্রণ কি ?
আমাদের ত্বকের মধ্যে মৃত কোষ, ময়লা,সেবাসিয়াস গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত তেল যখন লোম কূপের মধ্যে জমে যায় এবং বের হতে পারে না তখন এগুলো ত্বকের মধ্যে ব্রণ তৈরী করে।
ব্রণের প্রকারভেদ
ব্রণ বিভিন্ন আকারে হতে পারে, ছোট দাগ থেকে লক্ষণীয় সিস্ট পর্যন্ত। সাধারণত আমরা দুই ধরণের ব্রণ দেখতে পাই :
১. অ-প্রদাহজনক ব্রণ: হোয়াটহেডস, ব্ল্যাকহেডস।
- প্রদাহজনক ব্রণ: পিম্পলস, প্যাপিউলস, সিস্টস, নোডিউলস।
হোয়াটহেডস: এগুলি ছোট বা মাংসের রঙের দাগ বা বাম্প। সাধারণত এগুলো সাদা, বৃত্তাকার হয়ে থাকে। হোয়াইটহেডস দাগ সৃষ্টি করে না।
ব্ল্যাকহেডস: ব্ল্যাকহেডস হল ছোট, কালো রঙের দাগ বা বাম্প। হোয়াটহেডস যখন বাতাসের সংস্পর্শে আসে তখন ব্ল্যাকহেডস এ রূপান্তরিত হয়।
প্যাপিউলস: প্যাপিউল হল ত্বকের উপরিভাগের নিচের বাম্প যা 1 সেন্টিমিটার (সেমি) এর কম। সাধারণত প্যাপিউলের চারপাশের ত্বক স্ফীত হয়।
পিম্পলস: পিম্পলস সাধারণত বড়, সাদা বা হলুদাভ পুঁজে ভরা বৃত্তাকার হয় থাকে। এর চারপাশের অংশ হালকা লাল বা গোলাপী দেখায়। পুঁজগুলো সাধারণত প্রতিরোধক কোষ এবং ব্যাকটেরিয়া কোষের সংমিশ্রণ যা লোমকূপে ব্লক অবস্থায় থাকে।
নোডিউলস: নোডিউলগুলি শক্ত, স্ফীত পিণ্ড আকারের হয় থাকে । প্যাপিউলের মতো, নডিউলগুলির কোনও দৃশ্যমান মাথা নেই। নোডুলস ত্বকে কালো দাগ সৃষ্টি করতে পারে।
সিস্টস: সিস্টগুলি খুব বড়, বেদনাদায়ক, লাল বা সাদা হয় থাকে। এগুলো ত্বকের গভীরে অবস্থিত হয় । এই ব্রণের দাগ দীর্ঘস্থায়ী হয়।
শরীরের কোথায় ব্রণ হয়?
আমাদের অনেকেরই প্রশ্ন থাকে মুখে কেন ব্রণ হয় । আমাদের সারা শরীরে তেল গ্রন্থি বিদ্যমান। ব্রণের সাধারণ অবস্থান যেখানে তেল গ্রন্থি সবচেয়ে বেশি থাকে। যদিও অধিকাংশ মানুষের মুখে ব্রণ হয় এছাড়াও ব্রণ হতে পারে এমন সবচেয়ে সাধারণ জায়গাগুলি হল:
- মুখ;
- কপাল;
- বুক;
- কাঁধ;
- পিঠ;
ব্রণ কাদের বেশি হয়
আমরা অনেকেই বলি মেয়েদের মুখে ব্রণ কেন হয়। আসলে ছেলেমেয়ে উভয়েরই মুখে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্রণ হয় থাকে। ব্রণ সাধারণত উঠতি বয়সের (১৩ – ১৭) ছেলেমেয়েদের বেশি হয়। কারণ এই বয়সে ছেলেমেয়েদের শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন ঘটে। এছাড়া প্রায় সব বয়সের মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে ব্রণ দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে।
ব্রণ কেন হয়
ব্রণ হওয়ার অনেকগুলো কারণ বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন, তার মধ্যে প্রধান কারণগুলো হলো:
- ত্বকের অযত্ন;
- শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন;
- অনিদ্রা বা পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম না হওয়া;
- অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ;
- অতিরিক্ত ঘামানো;
- অতিরিক্ত স্ট্রেসে থাকা বা দুশ্চিন্তা করা;
- সঠিক প্রসাধনী ব্যবহার না করা;
- ধূমপান করা;
- বংশগতভাবে;
- কিছু হেলথ কন্ডিশন যেমন, পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পিসিওএস );
১. ত্বকের অযত্ন: ত্বকে অনেক সময় ধুলা-বালি, ঘাম, তেল, মৃত কোষ জমে থাকে। এগুলো ভালোভাবে পরিষ্কার না করলে এগুলো ত্বকের লোমকূপকে বন্ধ করে দেয় এবং ব্রণের সৃষ্টি করে।
২. শরীরে হরমোনাল পরিবর্তন: বয়ঃসন্ধি কালে ছেলেমেয়েদের শরীরে নানা ধরণের পরিবর্তন হয় তার মধ্যে হরমোনাল পরিবর্তন অন্যতম। এসময় ছেলেমেয়েদের মধ্যে বিভিন্ন ধরণের অবসাদ, দুশ্চিন্তার মধ্যে দিয়ে যা। এছাড়া, খাবার দাবারে অনিয়ম এবং শরীরের প্রতি তারা ঠিক ভাবে যত্নশীল হয় না। ফলে শরীরে হরমোনাল ইমব্যালেন্স দেখা দেয়। এতে তাদের ত্বকে ব্রণ তৈরী হওয়ার প্রবনতা বৃদ্ধি করে।
৩. অনিদ্রা বা পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম না হওয়া: আমাদের অনেকেরই রাতে অনিদ্রা বা পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম হয় না। রাতে পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুম না হলে রাতে আমাদের শরীরে যে শারীরিক কার্য সম্পাদন হয় তা ব্যাহত হয়। এতে আমাদের শরীরে অনেক প্রয়োজনীয় হরমোন নিঃসরণ হয় না যার ফলে আমাদের ত্বকে ব্রণ তৈরী হয়।
৪. অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ: অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের ফলে খাবার ঠিকভাবে হজম হয় না এবং পেট পরিষ্কার হয় না। এতে ত্বকে ব্রণ হওয়ার সম্ভবনা তৈরী হয়।
৫. অতিরিক্ত ঘামানো: অতিরিক্ত ঘামানোর ফলে শরীর থেকে অনেক পানি বের হয়ে যায়। ফলে শরীরে পানির অভাবে ত্বকে ব্রণের সৃষ্টি হয়।
৬. অতিরিক্ত স্ট্রেসে থাকা বা দুশ্চিন্তা করা: স্ট্রেস এবং দুশ্চিন্তা ব্রণ সৃষ্টি করে না, তবে এটি একজন ব্যক্তির হরমোনের ভারসাম্য পরিবর্তন করে ব্রণ কে ট্রিগার বা খারাপ করতে পারে। মানসিক চাপ একজন ব্যক্তির হরমোনের ভারসাম্য এবং ত্বকের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে। যখন একজন ব্যক্তি স্ট্রেস বা দুশ্চিন্তায় থাকে, তখন শরীর কর্টিসল নিঃসরণ করে। এর ফলে ব্রণ আরও খারাপ হতে পারে।
৭. সঠিক প্রসাধনী ব্যবহার না করা: আমাদের এক একজনের ত্বক এক একধরণের। যদি আমরা ত্বকের ধরণ অনুযাই প্রসাধনী ব্যবহার না করি হলে আমাদের ত্বকে ব্রণ হওয়ার সম্ভবনা থাকে।
৮. ধূমপান করা: ধূমপানের ফলে অ্যাটিপিকাল পোস্ট-অ্যাডলেসেন্ট(এপিএএ) ব্রণ হতে পারে।
৯. বংশগতভাবে: বংশগতভাবে ব্রণ হতে পারে। বংশ নির্ধারণ করতে পারে যে একজন ব্যাক্তির ইমিউন সিস্টেম এ প্রোপিওনিব্যাকটেরিয়াম ব্রণ (পি. একনেস) নামক ব্যাকটেরিয়া কতটা কার্যকর হবে। এই ব্যাকটেরিয়া ত্বকে ব্রণ হতে সাহায্য করে।
১০. কিছু হেলথ কন্ডিশনস যেমন,পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম (পি সিওএস ): পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম এর সাথে যুক্ত এন্ড্রোজেন হরমোন ত্বকে ব্রণ সৃষ্টি করে।
ব্রণ থেকে বাঁচার উপায়
কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। ব্রণ প্রতিরোধ করার জন্য আমরা বিভিন্ন ধরণের স্টেপ ফলো করতে পারি যেমন:
- দিনে কমপক্ষে দুই বার মুখ ধোয়া;
- মুখে খসখসে কাপড় বা প্যাড দিয়ে স্ক্র্যাব না করা;
- নিয়মিত চুলে শ্যাম্পু করা;
- রোদে বা আগুনের কাছে যাওয়ার আগে ভালো সানস্ক্রিন ব্যবহার করা;
- পর্যাপ্ত পরিমানে পানি খাওয়া;
- রাতে পর্যাপ্ত পরিমানে ঘুমানো;
- অস্বাস্থ্যকর খাবার বর্জন করা এবং নিয়মিত শাকসবজি, ঘরোয়া স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া;
- ত্বক অনুযাই সঠিক প্রসাধনী ব্যবহার করা;
- ধূমপান পরিহার করা;
- অতিরিক্ত স্ট্রেস এবং দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা;
ব্রণের চিকিৎসা
যদি আপনার ব্রণ মাঝারি বা গুরুতর হয় তাহলে একজন ভালো চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ এর পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা নিন।
একজন চর্মরোগ বিশেষজ্ঞ আপনাকে সাহায্য করতে পারেন:
- আপনার ব্রণ নিয়ন্ত্রণ করতে;
- আপনার ত্বকের দাগ বা অন্যান্য ক্ষতি দূর করতে;
- দাগ কম লক্ষণীয় করতে;
সাধারণত যেসব ওষুধ ব্রণ চিকিৎসার জন্য ব্যবহার করা হয়:
- টপিকাল রেটিনয়েডস;
- টপিকাল অ্যান্টিবায়োটিক;
- এজিলাইক অ্যাসিড;
- অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেট;
ব্রণ আমাদের ত্বকে বিভিন্ন করণে হয় থাকলেও; একটি নিয়মিত, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন আমাদের ত্বককে ব্রণ মুক্ত রাখতে পারে।
ব্রণমুক্ত, দাগহীন, মসৃন ত্বক আমাদেরকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলে এবং একটি সুস্থ, সুন্দর জীবনধারণে সাহায্য করে।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন:-
ব্রণ দূর হতে কেমন সময় লাগে?
ব্রণ নিজে থেকেই বা ন্যাচারালি দূর হতে এক থেকে দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। অনেকসময় ঔষধ বা চিকিৎসা এবং একটি ভাল ত্বকের যত্নের রুটিনের ফলো করার মাধ্যমে, ব্রণ দ্রুত দূর হয়। গুরুতর ব্রণের জন্য, ব্রণ দূর হতে কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে, এমনকি চিকিৎসার মাধমেও।
ব্রণ থেকে কি দাগ হতে পারে?
হ্যাঁ, কখনও কখনও ব্রণ দাগ হতে পারে। ব্রণ থেকে দাগ হয় যখন ব্রণ ত্বকের উপরের স্তরে প্রবেশ করে এবং ত্বকের গভীর স্তরগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। ব্রণের দাগের জন্য বিভিন্ন চিকিৎসা রয়েছে।
কিভাবে ব্রণ আমার মানসিক স্বাস্থ্য প্রভাবিত করে?
ব্রণ আপনার মানসিক স্বাস্থ্যে ব্যাঘাত ঘটাতে পারে কারণ এটি আপনার চেহারা এবং আত্মবিশ্বাসকে প্রভাবিত করে। প্রায়শই, হরমোনের কারণে হওয়া ব্রণ আপনার নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে। এটি স্ট্রেস তৈরি করতে পারে, যা ভবিষ্যতের ব্রেকআউটগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে। ব্রণ কিশোর এবং তরুণ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য চ্যালেঞ্জিং হতে পারে। যদি ব্রণের করণে আপনি প্রায়ই উদ্বিগ্ন বোধ করতে থাকেন বা এটি আপনাকে আপনার বন্ধু এবং পরিবারের সাথে সামাজিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করতে বাধা দেয়, তাহলে একজন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বা মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারের সাথে কথা বলুন।